এ গল্পটা বান্দরবনের নাফাখুম জলপ্রপাতের (ভ্রমণ ব্লগ ও গাইডলাইন)

নাফাখুমকে বলা হয় বাংলার নায়াগ্রা ,কেন বলা হয় জানেন ? সৌন্দর্য্যটা আসলে মুগ্ধ করার মত ,শুধু মুগ্ধ বললে বিশেষণটা একটু কম হয়ে যায় ,অনেক অনেক মুগ্ধ করে তাকিয়ে থাকার মতো..একটু বেশিই মুগ্ধ করার মতো ।

নাফাখুম জলপ্রপাত
নাফাখুম জলপ্রপাত


যাই হোক গল্পটা তাহলে শুরু করি :) আমাদের ভ্রমণ গ্রুপ স্বপ্নযাত্রা ট্রাভেল গ্রুপ থেকে একদল ভ্রমণ পিপাসু নাফাখুমের স্বপ্ন নিয়ে বান্দরবনের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলাম রাত সাড়ে এগারোটার বাসে ,কপাল অতিরিক্ত ভালো হলে যা হয় আরকি যে বাস আমাদের নামানোর কথা বান্দরবনে ছয়টায় সেটা নামালো সাড়ে আটটায় ,আহা আমাদের কপাল এত্তগুলা ভালো তাইনা ? 

যাই হোক লেইট ইজ লেট ,লেট নিয়েতো আর বসে থাকলে হবেনা ,দ্রুত নাস্তা করে একটা চান্দের গাড়ী নিয়ে নিলাম থানচি পর্যন্ত ।

সারারাত সব ঝিমানোর উপরে ছিলো সকালেও কেমন যেন সবাই মনমরা আমি কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম ‍‍ বউ মরছে নাকি ? না কারোই বউ মরেনাই :p  কিন্তু যখনই চান্দের গাড়ী চালু হলো আর পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলা শুরু করলো সবাই মনে হলো সতেজতার ডোজ পেলো অধিকাংশরাই গাড়ীর ছাদে চলে গেলো আর গলা খোলে সে কি গান !!!!

এতক্ষণে মনে হলো সবাই ট্যুরে আসছি ........মৌজ মাস্তি অন .....।। ইয়ো ইয়ো হানি সিংও :p

পাহাড়ের আঁকাবাঁকা অসাধারণ সব রাস্তা পেরিয়ে আমরা আড়াই ঘন্টার মধ্যেই পৌছে গেলাম থানচি উপজেলায় । 

থানচি থেকে যেতে হবে রেমাক্রি ,থানচি থেকে রেমাক্রি নৌকা দিয়ে তিন্দু আর বড় পাথুরিয়া হয়ে যেতে হয় । :) 


থানচি নেমেই স্হানীয় হোটেলে খাবার সেরে নিলাম ,তারপর গাইড সহ থানাতে এবং বিজিবি ক্যাম্পে আমাদের নাম ধাম পরিচয় জমা রেখে দুটো নৌকাতে উঠে পড়লাম :) 


নৌকা যাবে সাঙ্গু নদী হয়ে ,সাঙ্গু নদী অসম্ভব সুন্দর এক নদী ,নদীতে পানি কম আর এটাই এ নদীর সৌন্দর্য্যকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে ।

সাঙ্গু নদী মানেই অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার ভাব আর চারপাশের মুগ্ধ করার মতো প্রকৃতি ।
সাঙ্গু নদী দিয়ে রেমাক্রি যাবার সময় :) 


কোথাও কোথাও পানি অনেক কমে গেছে যে নৌকার মাঝিদের পানিতে নেমে নৌকা ঠেলে তারপর নিতে হয়েছে । 

তিন্দু অতিক্রম করে নৌকা ঠিক বড় পাথর এসে থামলো এখানে বিরতি ,বড় বড় পাথরে ভরপুর সাঙ্গু নদীর এ অংশটা । 

বড়পাথরের সৌন্দর্য্য না হয় ছবিতেই বর্ণণা দেই ....


এটাই হলো বড় পাথর এলাকা ,এর মধ্য দিয়েই নৌকা আপনাকে রেমাক্রি নিয়ে যাবে :)

বড় পাথর এলাকায় স্বপ্নযাত্রার সবাই বড় পাথরের উপরে উঠার মুহুর্ত

বড় বড় পাথরের মাঝ দিয়ে এভাবেই এগিয়ে চলে নৌকা :)

বড় পাথরের বিরতি শেষ করে আবারও নৌকাতে উঠে গেলাম কারণ সন্ধ্যার মধ্যে  আমাদের রেমাক্রি পৌছাতে হবে :) 

আবারও নৌকা চলতে লাগলো ,সন্ধ্যার মধ্যেই পৌছে গেলাম রেমাক্রি । 

রেমাক্রিতে আগেই আমাদের বুকিং করা ছিলো কটেজ ,সেখানে সবাই উঠে ফ্রেশ হয়ে গেলাম । আমাদের মধ্যে কিছু পাগলা আবার চলে গেলো রেমাক্রি ফলস এ গোসল করতে ।

রেমাক্রিতে ঠান্ডা কম কিন্তু আমার ধারণা ছিলো অনেক ঠান্ডা হবে এ বিষয়টা আমাকে অবাক করেছে ।
এটাই রেমাক্রি :) 

রাতে মুরগী ডাল আর আলু ভর্তা দিয়ে জম্পেশ খেয়ে নিলাম ,এবার ঘুমানোর পালা কাল স্বপ্নের নাফাখুম দেখবো :) 

রাত গভীর হচ্ছে সামনে সাঙ্গু নদী আর রেমাক্রি ফলস এর পানির কলতান । 

জীবন কিন্তু সুন্দর তাইনা ?

আমরা ঠিক করেছি সবার আগে নাফাখুম যাবো এজন্য ভোর পাঁচটায় উঠে যাবো ,যেহেতু সারাদিন জার্নির উপরে ছিলাম তাই শোয়ার সাথে সাথেই সবাই অতল ঘুমে তলিয়ে গেলো ।

যাই হোক ভোর হতেই সবাইকে ঢাকতেই দেখি সবাই রেডি ...

গন্তব্য : নাফাখুম জলপ্রপাত ...

হাটতে হবে : দুই ঘন্টা । 

আঁধো আলোতেই হাটা শুরু করে দিলাম ,মাঝখানে বিরতি নিলাম ,টুরিস্টরা এ সময় বের হয় বলে রাস্তাতেই আদিবাসীরা দোকান গুলো এ সময়ই খোলে ফেলে আমরা ডিম কলা আর চা খেয়ে নিলাম ।
স্বপ্নযাত্রার মেম্বাররা নাফাখুমের পথে 
নাফাখুম যাবার রাস্তায় এ সুন্দর ক্যাসক্যাডটি পাবেন :)


খেয়ে আবারও হাটা শুরু করলাম .....যাবার রাস্তাটা কিন্তু খুব সুন্দর :) 

দুর থেকেই কানে ভেসে আসলো পানির কলতান .....আহা সে মধুর শব্দ ....

এইযে এই যে ...নাফাখুম ...স্বপ্নের নাফাখুম ......

স্বপ্নের নাফাখুম

সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে আর স্হির থাকতে পারলাম না ,একদম ঝাঁপ দিয়েই দিলাম নাফাখুমের বুকে :)

ঝরনাতে আমাদের তিন মেম্বার জাফর,মাজেদ এবং আমি 

স্বপ্নযাত্রা ট্রাভেল গ্রুপের মেম্বাররা ঝরনার সামনে 


নাফাখুমের সবটুকু ভালোবাসা গায়ে মেখে আবারও ফিরে আসার পালা :) উল্টো পথে আবারও হাঁটা ধরলাম কারণ আমাদের আজই রাতের গাড়ীতে ঢাকা ফিরতে হবে । 

আবারও দু ঘন্টার হাটা পথ শেষ করে রেমাক্রিতে ,শেষ হইয়াও কিন্তু হইলোনা মানে রেমাক্রিতে কিন্তু চোখ ধাঁধানো একটা জলপ্রপাত আছে যা গোসল করার জন্য সবচেয়ে বেষ্ট ,এত বেস্ট একটা জলপ্রপাতে ওয়াটার থেরাপি নিবোনা তা কি হয় ?

জলথেরাপী অন ....
রেমাক্রি জলপ্রপাতে জলথেরাপি 

জলথেপারি নেওয়া শেষ করে দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে উঠে পড়লাম নৌকাতে ....আবারও সেই বড় পাথর তিন্দু পার হয়ে চলে আসলাম থানচিতে :)

থানচিতে এসে আমাদের প্লানটা ছিলো এখান থেকে নীলগিরি দেখে তারপর বান্দরবন ফিরবো । 

কিন্তু হায় বিধিবাম চান্দের গাড়ী সংকট অগতা উঠে পড়লাম বাসে ,বাস আমাদের নীলগিরি নামিয়ে দিবে তারপর সেখানে আমরা নীলগিরি দেখবো এর মাঝে বাস ড্রাইভার আমাদের জন্য একটা চান্দের গাড়ী নীলগিরি পাঠিয়ে দিবে :) 

বাস দেখে অধিকাংশরাই ছাদে উঠে পড়লো ,পাহাড়ী রাস্তায় বাসের ছাঁদে সেরাম এক ফিলিংস এর নাম :)


নীলগিরি নামিয়ে দিলো সবাই নীলগিরিতে হালকা সময় কাটালাম এর মাঝে আমাদের গাড়ীও হাজির সবাই গাড়ীতে উ্ঠে বান্দরবন চলে আসলাম :) 

ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে নিলাম :) রাত সাড়ে আটটায় বাস :) ভোর ৫টায় ঢাকাতে নামিয়ে দিলো 

অনেক গুলো স্মরণীয় স্মৃতি নিয়ে আমাদের নাফাখুমে স্বপ্নযাত্রা শেষ হলো ।।

এবার চলুন তাহলে ছোট ছোট টিপস গুলো শেয়ার করি 

# প্রথমে বান্দরবন সেখান থেকে যেতে হবে থানচি উপজেলা তারপর সেখান থেকে নৌকাতে তিন ঘন্টার রাস্তা রেমাক্রি :) রাতে রেমাক্রি থেকে তারপর দিন দুই ঘন্টা করে আসা যাওয়া চার ঘন্টার ট্রেকিং করলেই নাফাখুম জলপ্রপাত পাবেন :)

# থানচি যাবার ক্ষেত্রে  আপনি বাস বা চান্দের গাড়ীতে যেতে পারবেন কিন্তু বাসে যেতে প্রায় ছয় ঘন্টা লেগে যায় যা সময় নষ্ট এবং সাড়ে সাতটার আগে বাস ছাড়েনা সো সব মিলিয়ে বাসে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের সিদ্ধান্ত হয়না যদিনা আপনি দুই তিনজন হন ।


# থানচিতে পৌছে খেয়ে নিবেন ,নরমাল কিছু হোটেল আছে । এখানে গাইড ঠিক করতে হবে অনেক গাইডই আছে নিজেরাই এসে কথা বলবে ,তারপর গাইড নিয়ে পুলিশ এবং বিজিবির কাছে নাম ধাম ন্যাশনাল আইডি কার্ডের ফটোকপি জমা দিয়ে এখানকার সব ফরমালিটিজ শেষ করতে হবে । 

# থানচি থেকে গাইড নিতে হয় গাইড প্রথম দিন ৮০০ এবং দ্বিতীয় দিন সাতশো টাকা মোট ১৫০০ এবং রেমাক্রি থেকে নাফাকুম আবার আলাদা একজন গাইড নিতে হয় যাকে ৫০০ টাকা দিতে হয় । 

# থানচি থেকে যে নৌকা নিবেন সে নৌকা আপনাকে নিয়ে যাবে এবং এরপর দিন নিয়ে আসবে :) একটি নৌকাতে ছয়জনের বেশি বসতে দেয়না বিজিবি । 

# রেমাক্রিতে রাতে থাকার জন্য অনেকগুলো কটেজ আছে সবগুলোতেই প্রতি রাত থাকা একজনের জন্য ১৫০ টাকা নিবে এবং খাবার ১শ থেকে ১৫০ টাকা নিবে :) 

#রেমাক্রি থেকে হেটে নাফাখুম আসতে যেতে মোট ৪ ঘন্টার মতো লাগবে এজন্য এ ধরনের ট্যুর ফ্যামিলির জন্য আদর্শ নয় :) 

# যারা সাতার জানেন না তাদের জন্য লাইফ জ্যাকেট নেওয়ার পরামর্শ রইলো । 

# থানচিতে রবি এবং টেলিটক নেটওয়ার্ক পাবেন কিন্তু থানচির পর রেমাক্রিতে কোন নেটওয়ার্ক পাবেন না সো বাসায় যাকে যা জানানোর সব আগেই জানিয়ে নিবেন কিন্তু কারণ মা বাবা সবসময়ই তার সন্তানের জন্য চিন্তা করে তাই আগে জানিয়ে দিবেন যে নেটওয়ার্ক থাকবেনা :) 

# বড় পাথর এলাকায় অবশ্যই নৌকা থামিয়ে কিছু সময় কাটাবেন ভাল্লাগবে :)

ভাই সব বুঝলাম কিন্তু টাকা টাকার ব্যাপারটা ? 


এ ধরনের ট্যুর আমার দৃষ্টিতে খরুচে ট্যুর ৮-১০ জনের টিম গেলে ৫ হাজার টাকার মতো খরচ যাবেই ,তারপরও কোথায় কি খরচ সে ব্যাপারে পরামর্শের জন্য আমার ভ্রমণ গ্রুপ  স্বপ্নযাত্রাতে  পোস্ট করতে পারেন দ্রুত হেল্প পাবেন ইনশাল্লাহ ,খরচগুলো বিভিন্ন সময় উঠানামা করে বলে এখানে আর দিলাম না :) 

# গাইড এর নাম্বার সরাসরি এখানে দিলাম না আমাকে নক দিতে পারেন ফেইসবুকে  গাইডের নাম্বার দিয়ে দিবো 

সবইতো লিখলাম তারপরও কোন পরামর্শ বা কিছু জানতে আমাকে ফেইসবুকে নক দিন অথবা আমার ভ্রমণগ্রুপ  স্বপ্নযাত্রাতে  এ্যাড হয়ে যেতে পারেন 




‍‍ 

3 comments:

masud070 said...

you are a brave man bro, but i regret that i don't have any friend like this who will be interest to go there.

Billah Mamun said...

ভাই আপনিও আমাদের সাথে ঘুরতে পারেন ।। আমাদের সাথে ফেইসবুকে এ গ্রুপে জয়েন করুন ।

https://www.facebook.com/groups/1170429553017118/

Unknown said...

iam.....proud of
..to know this is our countries thims

Post a Comment

লেখাটি শেয়ার করুন