তখন ঘন ঘন বন জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছি সীতাকুন্ড
থেকে বান্দরবন সবখানে ।। বিভিন্ন জঙ্গলে ঝরনা দেখতে গেলে আমাদের মাঝে একটা আফসুস
থেকেই যেতো আহ এখানে যদি রাতে তাবু ফেলে থাকতে পারতাম তাহলে অসাধারণ হতো ।
কথাটা সাধারণভাবেই সবাই বললেও আফসুসটা বুঝা
যেতো , তখন আমরা জানতাম এ ব্যাপারে কিন্তু কিভাবে কি বা বনের নিরাপত্তা এসব
নিয়ে কোন ধারণা ছিলোনা,এজন্য উদ্যোগটা থমকে যেত ।।
একসময় আফসুসটা বাড়তেই থাকলো আফসুসের সাথে
আগ্রহটা যখন চরমে তখন তাবু ফেলে বনে থাকার ব্যাপারে খোজ খবর নিতে থাকলাম ।
যারা এর আগে বিভিন্ন জায়গায় তাবু ফেলে
রাত্রিবাস করেছে তাদের সাথে যোগাযোগ করে অনেক কিছুই জানলাম গ্রুপের সাথে কথা বলে
তাবু সংগ্রহ করলাম এবং শেষমেষ অভিজ্ঞ বড়ভাইদের সাথে কথা বলে সীতাকুন্ড এর পাহাড়ে
ঝরনার সামনে বনের ভিতরে তাবু ফেলে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম ।
যাত্রা হলো শুরু |
শীতের কোন এক ভোরে আমাদের প্রায় ১৫ জনের
ফিউরিয়াস ট্রাভেলার্স এর দল কুমিল্লা থেকে রওয়ানা হয়ে গেলাম সীতাকুন্ডের উদ্দেশ্যে
।। বাজারে নাস্তা করে আমাদের চিটাগাং এর বড় ভাই অপু ভাইকে নিয়ে বন জঙ্গলের দিকে
হাটা দিলাম ।
সবার মধ্যে উৎসব মুখর একটা ভাব কাজ করছে তার
সাথে সবাই এক্সাইটেডও বটে কারণ এতদিন আমরা এগুলো বড় বড় ট্রেকারদের বা
ভ্রমণপিপাসুদের করতে দেখেছি সেটা আজ আমরা নিজেরা করতে যাচ্ছি সেটা অবশ্যই এক
অসাধারণ অনুভুতি এনে দেয় ।
সাথে তাবু ,বাজার সদাই নিয়ে দুর্বার গতিতে ছুটে চলছি আমরা |
হাটছি তো হাটছি বন জঙ্গল আর পাহাড় পেরিয়ে মাঝ
পথে পেলাম লাউক্ষেত আমাদের প্রধান শেফ তানবির আমতা আমতা করে বললো ,
রাতের জন্য কি লাউ নিবো ? মুরগীর
সাথে লাউ কিন্তু খুব যায়
-তথাস্তু !! প্রধান শেফ যা বলে তাই হবে ,
নিয়া নে ।
কারো হাতে তাবু ,কারো হাতে দঁড়ি ,কারো
হাতে মুরগী,কারো হাতে লাউ ,কারো হাতে
বাজারের ব্যাগ,রাস্তায় যেই দেখে সেই বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে
ভাই আপনারা কোথা থেকে আসছেন আর বাজার সদাই নিয়ে যাচ্ছেন কোথায় ? !! আমরাও
মজা করে বলি ভাই বিয়ের অনুষ্টান আছে ।।
পুলাপাইন জঙ্গলে ওভার এক্সাইটেড |
এক জায়গায় এসে থমকে গেলাম সামনে পানি খাড়া বিরাট এক পাথরের মাঝ দিয়ে খাজ কাটা !!!!! যাবো কিভাবে !!!!!! অপু ভাই হাসি দিয়ে বললো এবার কিন্তু আসল পুরুষের পরীক্ষা হবে বলেই উনি দঁড়ি নিয়ে পানি পেরিয়ে উঠে গেলেন পাথরের উপরে এবার বললেন একজন একজন করে আসো পরীক্ষা দাও । নিতান্ত অনিচ্ছায় ব্যাগটা মাথার উপর দিয়ে ধরে পানিতে হেটে গেলাম এবার দঁড়ি দিয়ে বেঁয়ে উঠার পালা ব্যাগটা প্রথমে দঁড়িতে বেঁধে দিয়ে তারপর বহু কষ্টে উঠতে হলো যেহেতু পানি গভীর ছিলো সেহেতু পানি থেকে সরাসরি দড়ি বেয়ে উঠাটা কঠিন ছিলো তার উপর আমরা সবাই এক্ষেত্রে একদমই নতুন ..ব্যাগ পাস করে করে একজন একজন করে পাথরের খাজ দিয়ে অর্ধেক উঠলাম এবার আরেকধাপ উঠার পালা এবার দঁড়ি লাগবেনা কিন্তু দুইদিকে পাথরে পা রেখে এগিয়ে যেতে হবে যেখানে সামান্য ভুল বড় দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে ।। ভয় আর উত্তেজনা দুইটাই কাজ করছিলো আমাদের মাঝে ।
এ জায়গায় আসল পুরুষ পরীক্ষার সম্মুখিন |
এতক্ষণ সবার মাঝে টেনশন ছিলো কিন্তু যেই
সবাই ঠিক ঠাকমত পেরিয়ে আসতে পারলো তখনই সবার বাহাদুরি শুরু হয়ে গেলো ধুর এটা কোন
ব্যাপার হলো ,এসব পাহাড় কত বেয়ে বেয়ে উঠছি ।
চলছে আসল পুরুষ পরীক্ষা :p |
এবার অবাক হবার পালা !! এখানেই আমরা তাবু ফেলবো
!! সিরিয়াসলী !! চারদিকে পাহাড় আর মাঝখানে আমাদের তাবু ফেলবো আবার সামনে ছোটখাট একটা ঝরনা !!!
বেশিক্ষণ অবাক হবার সুযোগ পেলাম না কারণ
সন্ধ্যা তখন ঘনিয়ে আসছে সন্ধ্যার আগেই আমাদের প্রচুর লাকড়ি জোগাড় করতে হবে রাতে
রান্না আছে আবার সারারাতের ক্যাম্প ফায়ার
এর জন্য লাকড়ি ।।
আহ তাবু ফেলেছি আমরা এখানে ।। সামনে ছোট ঝরনা কল কল পানির শব্দ চারকিদে উচু উচু পাহাড় এর মাঝখানে আমরা ...লাইফ ছিলো সত্যিই বিউটিফুল |
শুরু হয়ে গেলো “”মিশন লাকড়ি
জোগাড় “” পাহাড় জঙ্গল থেকে যে যেভাবে পারলো জোগাড় শুরু
করলো গাছের বড় বড় শুকনা লাকড়িগুলো কাটা শুরু হলো কেউ কেউ আবার পুরাতন গাছের গোঁড়া
উঠানো শুরু করলো কারণ গাছের গোড়া অনেক সময় ধরে জ্বলে ।
দশের বোঝা নেবার কারণে একের লাটি না হয়ে অনেক
পরিমাণ লাকড়ি জোগাড় হয়ে গেলো ।
লাকড়ি জোগাড় করেই রাতের জন্য চাল আর মুরগী জবাই
করে বাকীগুলো সব এগিয়ে নিয়ে একটু বিরতি সবারই ক্ষিধা লাগছে ।। ব্যাগ থেকে মুড়ি ,পেয়াজ
চানাচুর বের করে সবাই মুড়ি মাখা করে খেলাম ।।
আমাদের ক্যাম্পিং লোকেশন |
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে বন থেকে বাঁশ কেটে
আমাদের পাগলা বন্ধু গাইয়ুম পানির মাঝঝানে বসিয়ে দিলো এক মশাল !! বাহ ধপ ধপ করে
জ্বলছে মশাল ।।
আগুন জ্বালিয়ে ভাত বসিয়ে দেওয়া হলো এর মাঝে
মুরগী কেটে তৈরি করা হলো ভাত হয়ে যাবার পর লাউ দিয়ে মুরগী রান্না বসিয়ে দিলো এর
মাঝে আবার কয়েকজন সালাদ কেটে সব তৈরি করে নিলো ।।
ভাতও রান্না শেষ মুরগীও রান্না শেষ সালাদও তৈরি
! তবে কিসের জন্য অপেক্ষা !! সবার পেটে আগুন জ্বলতেছে খিদায় !!
সকল ভুখা নাঙ্গাদের জন্য খাবার রেডি .লাউ দিয়ে মুগরী ..আহ অমৃত |
সবাই ঝটপট প্লেট নিয়ে বসে পড়লো ।। মুখে দিয়েই
অমৃত ।। লাউ দিয়ে মুরগী আর সালাদটা এত স্বাধ হয়েছে বলার বাইরে ।।
অপু ভাইতো সালাদ দিয়েই দুই প্লেট সাবাড় করে ফেললো , তারপর যখণ দেখলো
মুরগীটা আরও বেশি স্বাধ উনি বললো আমি কি তাহলে সালাদ দিয়ে দুই প্লেট খেয়ে ভুল
করলাম !! হাসি তামাশায় পেট পুরে সবাই খেলো কেউ কেউতো বলেই ফেললো আজকে গলাপর্যন্ত
খেয়েছি ।
ওদিন ছিলো পূর্ণিমা মনে হলো বনের ভিতর ছায়ার এক অদ্ভুত খেলা , দ্রুত
পানি গরম করে কফি তৈরি করে পাহাড়ের একটু উপরে উঠে বসলাম হাতে কফির মগ ,আকাশ
ভর্তি ইয়া বড় একটা চাঁদ , আহ ! লাইফ ইজ বিউটিফুল ।
বন্ধু কৌশিক শুরু করলো গান গাওয়া এবার আর পায়
কে সবাই যোগ দিলো শুরু হলো গানের পর গান ,আমাদের
ডিকশনারীতে যত গান ছিলো একের পর এক চলতেই থাকলো মাঝরাত পর্যন্ত ।
সারাদিনের পরিশ্রমের কারণে সবাই ক্লান্ত ছিলো
তাই রাত তখন দুইটা একে একে সবার চোখই ঝাঁপসা হয়ে আসছে তাই একে একে সবাই ঘুমাতে
গেলো । কয়েকজন অবশ্য জেগেই ছিলো সারারাত ।।
সকালে উঠেই ঝরনাতে শান্তির গোসল সেরে নিলো ।
গোসল সারতে সারতে তানবির আবার সকালের খিচুরি বসিয়ে দিলো ,ঝটপট খিচুরি
খেয়ে সব গুছিয়ে নিলাম ।
সকালে ঝরনাটাকে আমরা ন্যাচারল ওয়াটার কিংডম বানিয়ে ফেলেছিলাম |
আজ আমাদের ফিরে আসার পালা । আমরা সিদ্ধান্ত
নিলাম নতুন অন্য একটা রাস্তায় ফিরবো তাই এজন্য
সব গুছিয়ে যেখানে ক্যাম্পিং করেছি তা ধুয়ে মুছে সব পরিষ্কার করে দিয়ে হাঁটা
শুরু হলো সামনের দিকে ।।
এ জায়টা ভয়ংকর ছিলো বিশেষ করে ফসকে গেলে প্রচন্ড আঘাত পাবার সম্ভবনা ছিলো । |
সামনে এসেই পড়লাম ঝরনার সামনে , কিন্তু
কিন্তু !! এ ঝরনা পেরিয়ে আমরা উপরে উঠবো কিভাবে !!! আবারও সেই দড়ি ।। আমরা কয়েকজন
অনেক রিস্কি একটা পথ বেয়ে কোনরকমে উঠলাম উঠে দড়ি বেধে দিলাম একে একে সব তাবু আর
ব্যাগ উপরে উঠিয়ে একজন একজন করে ঝরনার পানির সাথে যুদ্ধ করে উঠা শুরু করলো ।। এ
সময়টা অনেক ভয়ের ছিলো কারণ এটা আগেরটার চেয়েও আরও বেশি ঝুকিপূর্ণ ছিলো ।।
যাই হোক অল্প স্বল্প ব্যাথা পেলেও বড় কোন
দুর্ঘটনা ছাড়াই পেরিয়ে আসলাম ।।
আবার ঝিরি ধরে হাটার পালা , আবার
!! আবার !! ঝামেলা !!! হয়তো সাতরে যেতে
হবে না হয় ঝোপঝাড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতে
হবে । যেহেতু আমাদের সাথে ভারী ব্যাগ আর
তাবু্ আছে তাই সাতরে যাবার প্লান বাদ দিয়ে ঝোপ ঝাট কেটেই সামনে এগিয়ে যেতে হবে ।।
এত ঘন ঝোপ ঝাড় জীবনে দেখিনি :( তারপরও যেতে হবে এটাই বাস্তবতা ,ঝোপঝাট
ঠেলে হাত পায়ের অবস্হার চৌদ্দটা বাজিয়ে অবশেষে পার হয়ে লোকালয়ে যাবার পথ খুজে
পেলাম ।
এ যেন কান্ট্রি রোড টেক মি হোম ....অল্প একটু
হাটতেই লোকালয়ে চলে আসলাম ।। স্হানীয় হোটেলে নাস্তা সেরে বাড়ীর গাড়ীতে উঠলাম ,আর
মায়ের কাছে ফোন দিয়ে বললাম ""হ্যালো মা ,আমি আসছি "
:)
আমার আরও ভ্রমণ ব্লগগুলো এখান থেকে পড়তে পারেন
আমাকে ফেইসবুকে খুজে পাবেন এখানে
আমার আরও ভ্রমণ ব্লগগুলো এখান থেকে পড়তে পারেন
আমাকে ফেইসবুকে খুজে পাবেন এখানে
0 comments:
Post a Comment